আজ, না না, কাল থেকে পরপর মিরাকেল হচ্ছে আমার সাথে। গত দুই সপ্তাহ ধরে একটা
গান রোজ রোজ শুনছিলাম। কিন্তু কিছুতেই গাইতে পারছিলাম না। সুর বসছিল না। আজ হঠাত
একবারে গেয়ে ফেললাম এই গানটা –
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক ॥
পূজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক
তবে তাই হোক।
অশ্রু-আঁখি- 'পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ
তবে তাই হোক ॥
কাল থেকে আমি ইচ্ছা করলেই কাকাই কে দেখতে পাচ্ছি – স্পষ্ট! দেখলাম কাকাই
হাত নেড়ে সবজান্তাদের মতন বলছে, “ আরে ধুর, এরা কিসসু জানেনা, কিসসু পারেনা । কি যে এত যন্ত্র লাগাল আর ছুঁচ ফোটাল! পারলোই না কিছু
করতে। আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়া অত সোজা নাকি! ” কাকাই যেমন করে বলে আর কি। যেন কেউ
কিচ্ছু করতে পারেনা এই দুনিয়ায়।
এখন যখনই চাইছি কাকাই আমার সামনে এসে বসছে, গল্প করছে – ছোটবেলার গল্প।
কেমন যেন কাকাই ওর নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আমার পাশে বিছানায় এসে বসেছে। হয়ত
কাকাইয়ের শেষ সময়টা নিজের চোখে দেখলাম না বলে কিনা, কিছুতেই মনে হচ্ছে না যে কাকাই
নেই। যখনই কাকাইয়ের ছবি খুলে বসছি, আমি যেন কাকাইকে পাশেই পাচ্ছি। আজ মনে হচ্ছে
কাকাই যেন ওই ঘরটা, ওই কষ্টে ভরা শরীরটা থেকে বেরিয়ে সবসময়ের জন্য আমাদের সবার
পাশে, সবার আরও কাছে চলে এসেছে। যতদিন ওই শরীরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, ততদিন মাত্র
একটা জায়গার মধ্যে সীমিত ছিল কাকাই। আর আজ একসাথে সবার সাথে, সবার পাশে সবসময় আছে
কাকাই। আমার সাথে তো যখন তখন আমি চাইলেই দিব্যি গল্প করছে – ঠিক যেমন পুপে হওয়ার
আগে রোজ সকালে এসে আমার সাথে গল্প করত।
আমার মনে নেই তবে কাকাইয়ের কাছেই শোনা, ছোটবেলায় আমার ডিম খেতে খুব ভালো
লাগত কিন্তু মা দিত না। তাই কাকাই আমাকে একটা ট্রাঙ্কের ওপর দাঁড় করিয়ে বলতে
শিখিয়েছিল “আমাদের দাবি মানতে হবে, আমাকে ডিম দিতে হবে”! সেই থেকেই শুরু। পুরনো
স্মৃতি কি যে লিখব আর কি যে বাদ দেব। যখনই আবার ভাই বোনরা সব আড্ডা দিতে বসব, এইসব
স্মৃতিচারণই করব। কিন্তু আজ একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে। কাকাই আমার কাছে শুধু একটা
মানুষই না, একটা গোটা সম্পর্ক। প্রথমত তো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে কাকাই নেই।
যদি তাও আমাকে সবাই জোর করে বিশ্বাস করাতে চায় যে কাকাই নেই, তাহলে আমি বলব যে এই
সম্পর্কটা কোনদিন আমার কাছে “নেই” হয়ে যাবে না। কিছু কিছু এমন নিঃস্বার্থ সম্পর্ক
থাকে যা অজর, অমর। কোনদিন তার কোন ক্ষয় নেই। কিছু কিছু এমন জীবন্ত মানুষ থাকে,
যাকে আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় কোনদিন কল্পনাই করতে পারব না। আমার কাকাই আমার কাছে ঠিক
তেমনি এক মানুষ, তেমনি এক সম্পর্ক। এই যে আমি কাকাইকে নিয়ে লিখছি, একটা লাইনও আমি
এমন লিখতে পারব না যাতে বোঝায় যে কাকাই নেই। কারণ কাকাই কড়া চোখে আমার সামনে বসে
আছে। এসব লিখলেই খুব বকবে আমাকে। আর কথাই বলবে না আমার সাথে তাহলে। আর আমি আজ
পর্যন্ত কাকাইকে খুব কমই রাগিয়েছি।
তবে চিন্তা করিসনা কাকাই। আমি অনেক চেষ্টা করছি ভাবতে যে তুই নেই, তুই নাকি
বেঁচে নেই! তোর সাথে নাকি আমার কোনোদিন আর দেখা হবেনা, কথা হবেনা। কিন্তু বিশ্বাস
কর, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মানতে পারছি না। কোনোদিন বিশ্বাস করতেও চাইনা রে
কাকাই। আজ তুই একটা কথা জেনে রাখ। আমার
কাছে কিন্তু তুই আছিস, সব সময়, কোত্থাও যাসনি, কিচ্ছু হয়নি তোর। শুধু গত চার বছর
ধরে যে কষ্টটা তুই পাচ্ছিলি, সেটা কোথাও হারিয়ে গেছে। তুই হারাসনি, আমরাও হেরে
যাইনি। আবার যখন আমি কলকাতা যাব, তোর জন্য ভাকরবাড়ি নিয়ে যাব, রাজা যখন আসবে, তখন
তোর প্রিয় গন্ধটা নিয়ে আসবে। আর আমরা গেলে কাকিমা আবার একদিন পাঁঠার মাংস রান্না
করে খাওয়াবে আর তুই বসে দেখবি আমাদের খাওয়াটা। আর পুপে বড় হলে যখন ঘুমাতে চাইবে
না, আমি কিন্তু বেল বাজিয়ে বলব যে কাকাই এসেছে। রোজ রোজ মিথ্যে বেল বাজাতে যেন
আমাকে না হয়। এক একদিন সত্যিই তুই আসিস কিন্তু। জানিস, পুপে এখন জানে যে আমার
কাকাই মানে ওর ছোড়দাদু। ও জানে ওর ছোড়দাদু বিস্কুট খায় আর ওকে দিদিভাই বলে। আর ও
একটু বড় হলে এটাও জানবে যে ওর জীবনের প্রথম ছবিটা ওর ছোড়দাদু তুলে দিয়েছিল। আর
কদিন পর আবার কলকাতা যাচ্ছি। তোর জন্য কি আনব বলিস, কেমন? আর গিয়ে আবার গল্প হবে।
অপেক্ষায় রইলাম তোর সাথে আড্ডা মারার। ভালো থাকিস।
-
পাই
No comments:
Post a Comment