ছোটবেলায় অনেকের মা কে দেখতাম তারা তাদের সন্তানদের প্রশংসা সবার সামনে করত। আমার মাকে কোনদিন তা করতে দেখিনি। হতে পারে প্রশংসা করার মত কিছু ছিল না আমার মধ্যে। কিন্তু মা বলত “তোমার প্রশংসা আমি কখনও করব না। তোমার কাজই এমন ভালো হওয়া চাই যাতে অন্যরা তোমার প্রশংসা করে। নিজের ঢাক নিজে বাজাবে না কখনও। অন্যরা বাজাবে। ছোটবেলার কাঁচা মনে ভাবতাম, তবে কি মা আমাকে ভালোবাসে না?
আজ জীবনের ৩৩টি বসন্ত কাটিয়ে বুঝি মা আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আর তাই
এই সুন্দর শিক্ষা সেই ছোটবেলায় দিয়েছিল। এবং আজ যখন আমি নিজে
একটি কন্যা সন্তানের মা, আমিও তাকে এই একই শিক্ষা দেব। কিন্তু তা বলে কি আমার মা
কোনদিন কারুর কাছে আমার কোনও প্রশংসাই করেনি? নিশ্চয়ই করেছে। আমি কলেজে ওঠার পর
যখন আর মায়ের প্রশংসায় আমার আর মাথা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন মা দিব্যি সবার
সামনে আমার প্রশংসা করত। বলত “রুম্পাই কে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই শুধু ওর
পড়াশুনাটা ছাড়া”। মা কোনদিন যেমন আমার কোন সুকর্মের দায় নিতে আসেনি, তেমনি, আমাদের কুকর্মের
সব দায়ে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। দোষ করলেই বলেছে “নিশ্চয়ই আমার শিক্ষায়
কোন ত্রুটি ছিল। আর ভালো কাজ করলে কখনও বলতে শুনিনি “কেমন শিখিয়েছি
আমার মেয়েকে দেখেছ?”
এখন যখন আমি
মাকে বলি যে তোমার শিক্ষায় বড় হয়ে আমার কোন আপসোস নেই বরং অনেক গর্ব আছে, তখন মা
বলে মায়ের কিন্তু নাকি একটু আপসোস আছে। মা নিজে যেমন কাঠখোট্টা, আমিও নাকি তেমনি
হয়েছি। আমার মধ্যে তেমন ন্যাকামি নেই, লোক দেখানো ভালোবাসা বা আদিখ্যেতা নেই। আর
এখন দুনিয়ায় নাকি এসবেরই বেশী দাম। আমার
কিন্তু দিব্যি লাগে এই বিনা ন্যাকামির কাঠখোট্টা জীবন। কারণ আমি বিশ্বাস করি লোক
দেখানো ন্যাকামি দিয়ে তাৎক্ষণিক পাত্তা পাওয়া গেলেও শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা
কোনটাই পাওয়া যায় না।
হঠাত করে
মায়ের কথা, মায়ের শিক্ষা নিয়ে কেন লিখতে বসলাম? কাল মা ফিরে গেল নিজের সংসারে । মা
একমাসের জন্য আমার ব্যাঙ্গালোরের সংসারে এসেছিল। আমার মেয়েকে দেখাশুনা করে যে
দিদি, সে একমাসের ছুটিতে গেছে, তাই। আমরা অফিস গেলে মেয়েকে দেখবে বলে। সেই মা রোজ
ভোর ৬টায় উঠে কাজ করতে শুরু করে দিত। একেবারে চা বানিয়ে আমাদের ঘুম থেকে ডাকত। মা
আসার আগে আমাদের মেয়ের জীবনে কোন সঠিক রুটিন ছিল না। মা এসে কি সুন্দর জীবনে একটা
নিয়ম এনে দিয়েছে! সময়ে স্নান, খাওয়া, ঘুম। আমরা অফিসে চলে গেলে মা ওর সাথে বই নিয়ে
বসত। টুনটুনির গল্প, ইকিরমিকির, আগডুম বাগডুম আরও কত কি! এই কদিনে মা দেখিয়ে এবং
শিখিয়ে দিয়ে গেল কি সহজে শিশুদের ভালোবাসা পাওয়া যায়, কি সহজে বাচ্চা মানুষ করা
যায়। কোন আড়ম্বর লাগেনা, লোকদেখানো ন্যাকামি লাগেনা। নিছক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর
ভালো চাওয়া দিয়েই এই সহজ কাজটা হয়ে যায় অনায়াসেই।
এইকদিন মা
আমাকে কোন কাজ করতে দেয়েনি। কিছু বললেই বলত “আমি চলে গেলে তো সব কাজই তোকে করতে
হবে। আমি তো তোকে আরাম দিতেই এসেছি”। কিন্তু আজ মা আবার নিজের সংসারে ফিরে যাওয়ায়
সব কাজ নিজেকে করতে কোন কষ্টই আমার হচ্ছে না। কিন্তু মায়ের এত ভালোবাসার কথা মনে
করে আর মাকে মনে করে বাচ্চাদের মত কষ্ট হচ্ছে। মা কাল ফিরে গিয়ে এত সুন্দর একটা
কথা বলল... একটা কথাতেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিল মা! মা বলল, “লোকে বলে আসলের চেয়ে
সুদের প্রতি দরদ বেশী। কিন্তু, আমার নাতনির জন্য অত কষ্ট হচ্ছে না। কারণ আমি জানি
ওর মা বাবা ওর সাথে আছে। আমার তোর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, চিন্তা হচ্ছে, কারণ ওখানে
তুই একা”।
সত্যিই মা যে
আমার কত বড় ভরসা, আশ্রয়, শিক্ষা, সে আমিই জানি। শুধু আমার মা বলেই না। কিন্তু এই মায়ের কাছেই আমি শিখেছি কি করে কোনরকম
কপটতার আশ্রয় না নিয়ে শুধু মাত্র নিজের সুকর্ম দিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান আর
ভালোবাসা পেতে হয়। আর আমার বাকি জীবনের এখন একটিই উদ্দেশ্য। আমার মায়ের মত একজন মা
হয়ে ওঠা। আমি যেন আমার এই কন্যার এতটাই ভরসার জায়গা, আশ্রয় হয়ে উঠতে পারি। যে
সুশিক্ষায় আমি বড় হয়েছি, মেয়েকেও যেন সেই শিক্ষায় বড় করতে পারি। মাতৃঋণ তো কোনদিন
শোধ হয়না। তবু মায়ের যোগ্য সন্তান আমি সেদিনই হয়ে উঠব।
No comments:
Post a Comment