Jul 22, 2014
Jul 19, 2014
কাকাই তুই
আজ, না না, কাল থেকে পরপর মিরাকেল হচ্ছে আমার সাথে। গত দুই সপ্তাহ ধরে একটা
গান রোজ রোজ শুনছিলাম। কিন্তু কিছুতেই গাইতে পারছিলাম না। সুর বসছিল না। আজ হঠাত
একবারে গেয়ে ফেললাম এই গানটা –
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক ॥
পূজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক
তবে তাই হোক।
অশ্রু-আঁখি- 'পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ
তবে তাই হোক ॥
কাল থেকে আমি ইচ্ছা করলেই কাকাই কে দেখতে পাচ্ছি – স্পষ্ট! দেখলাম কাকাই
হাত নেড়ে সবজান্তাদের মতন বলছে, “ আরে ধুর, এরা কিসসু জানেনা, কিসসু পারেনা । কি যে এত যন্ত্র লাগাল আর ছুঁচ ফোটাল! পারলোই না কিছু
করতে। আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়া অত সোজা নাকি! ” কাকাই যেমন করে বলে আর কি। যেন কেউ
কিচ্ছু করতে পারেনা এই দুনিয়ায়।
এখন যখনই চাইছি কাকাই আমার সামনে এসে বসছে, গল্প করছে – ছোটবেলার গল্প।
কেমন যেন কাকাই ওর নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আমার পাশে বিছানায় এসে বসেছে। হয়ত
কাকাইয়ের শেষ সময়টা নিজের চোখে দেখলাম না বলে কিনা, কিছুতেই মনে হচ্ছে না যে কাকাই
নেই। যখনই কাকাইয়ের ছবি খুলে বসছি, আমি যেন কাকাইকে পাশেই পাচ্ছি। আজ মনে হচ্ছে
কাকাই যেন ওই ঘরটা, ওই কষ্টে ভরা শরীরটা থেকে বেরিয়ে সবসময়ের জন্য আমাদের সবার
পাশে, সবার আরও কাছে চলে এসেছে। যতদিন ওই শরীরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, ততদিন মাত্র
একটা জায়গার মধ্যে সীমিত ছিল কাকাই। আর আজ একসাথে সবার সাথে, সবার পাশে সবসময় আছে
কাকাই। আমার সাথে তো যখন তখন আমি চাইলেই দিব্যি গল্প করছে – ঠিক যেমন পুপে হওয়ার
আগে রোজ সকালে এসে আমার সাথে গল্প করত।
আমার মনে নেই তবে কাকাইয়ের কাছেই শোনা, ছোটবেলায় আমার ডিম খেতে খুব ভালো
লাগত কিন্তু মা দিত না। তাই কাকাই আমাকে একটা ট্রাঙ্কের ওপর দাঁড় করিয়ে বলতে
শিখিয়েছিল “আমাদের দাবি মানতে হবে, আমাকে ডিম দিতে হবে”! সেই থেকেই শুরু। পুরনো
স্মৃতি কি যে লিখব আর কি যে বাদ দেব। যখনই আবার ভাই বোনরা সব আড্ডা দিতে বসব, এইসব
স্মৃতিচারণই করব। কিন্তু আজ একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে। কাকাই আমার কাছে শুধু একটা
মানুষই না, একটা গোটা সম্পর্ক। প্রথমত তো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে কাকাই নেই।
যদি তাও আমাকে সবাই জোর করে বিশ্বাস করাতে চায় যে কাকাই নেই, তাহলে আমি বলব যে এই
সম্পর্কটা কোনদিন আমার কাছে “নেই” হয়ে যাবে না। কিছু কিছু এমন নিঃস্বার্থ সম্পর্ক
থাকে যা অজর, অমর। কোনদিন তার কোন ক্ষয় নেই। কিছু কিছু এমন জীবন্ত মানুষ থাকে,
যাকে আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় কোনদিন কল্পনাই করতে পারব না। আমার কাকাই আমার কাছে ঠিক
তেমনি এক মানুষ, তেমনি এক সম্পর্ক। এই যে আমি কাকাইকে নিয়ে লিখছি, একটা লাইনও আমি
এমন লিখতে পারব না যাতে বোঝায় যে কাকাই নেই। কারণ কাকাই কড়া চোখে আমার সামনে বসে
আছে। এসব লিখলেই খুব বকবে আমাকে। আর কথাই বলবে না আমার সাথে তাহলে। আর আমি আজ
পর্যন্ত কাকাইকে খুব কমই রাগিয়েছি।
তবে চিন্তা করিসনা কাকাই। আমি অনেক চেষ্টা করছি ভাবতে যে তুই নেই, তুই নাকি
বেঁচে নেই! তোর সাথে নাকি আমার কোনোদিন আর দেখা হবেনা, কথা হবেনা। কিন্তু বিশ্বাস
কর, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মানতে পারছি না। কোনোদিন বিশ্বাস করতেও চাইনা রে
কাকাই। আজ তুই একটা কথা জেনে রাখ। আমার
কাছে কিন্তু তুই আছিস, সব সময়, কোত্থাও যাসনি, কিচ্ছু হয়নি তোর। শুধু গত চার বছর
ধরে যে কষ্টটা তুই পাচ্ছিলি, সেটা কোথাও হারিয়ে গেছে। তুই হারাসনি, আমরাও হেরে
যাইনি। আবার যখন আমি কলকাতা যাব, তোর জন্য ভাকরবাড়ি নিয়ে যাব, রাজা যখন আসবে, তখন
তোর প্রিয় গন্ধটা নিয়ে আসবে। আর আমরা গেলে কাকিমা আবার একদিন পাঁঠার মাংস রান্না
করে খাওয়াবে আর তুই বসে দেখবি আমাদের খাওয়াটা। আর পুপে বড় হলে যখন ঘুমাতে চাইবে
না, আমি কিন্তু বেল বাজিয়ে বলব যে কাকাই এসেছে। রোজ রোজ মিথ্যে বেল বাজাতে যেন
আমাকে না হয়। এক একদিন সত্যিই তুই আসিস কিন্তু। জানিস, পুপে এখন জানে যে আমার
কাকাই মানে ওর ছোড়দাদু। ও জানে ওর ছোড়দাদু বিস্কুট খায় আর ওকে দিদিভাই বলে। আর ও
একটু বড় হলে এটাও জানবে যে ওর জীবনের প্রথম ছবিটা ওর ছোড়দাদু তুলে দিয়েছিল। আর
কদিন পর আবার কলকাতা যাচ্ছি। তোর জন্য কি আনব বলিস, কেমন? আর গিয়ে আবার গল্প হবে।
অপেক্ষায় রইলাম তোর সাথে আড্ডা মারার। ভালো থাকিস।
-
পাই
আমার মা
ছোটবেলায় অনেকের মা কে দেখতাম তারা তাদের সন্তানদের প্রশংসা সবার সামনে করত। আমার মাকে কোনদিন তা করতে দেখিনি। হতে পারে প্রশংসা করার মত কিছু ছিল না আমার মধ্যে। কিন্তু মা বলত “তোমার প্রশংসা আমি কখনও করব না। তোমার কাজই এমন ভালো হওয়া চাই যাতে অন্যরা তোমার প্রশংসা করে। নিজের ঢাক নিজে বাজাবে না কখনও। অন্যরা বাজাবে। ছোটবেলার কাঁচা মনে ভাবতাম, তবে কি মা আমাকে ভালোবাসে না?
আজ জীবনের ৩৩টি বসন্ত কাটিয়ে বুঝি মা আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আর তাই
এই সুন্দর শিক্ষা সেই ছোটবেলায় দিয়েছিল। এবং আজ যখন আমি নিজে
একটি কন্যা সন্তানের মা, আমিও তাকে এই একই শিক্ষা দেব। কিন্তু তা বলে কি আমার মা
কোনদিন কারুর কাছে আমার কোনও প্রশংসাই করেনি? নিশ্চয়ই করেছে। আমি কলেজে ওঠার পর
যখন আর মায়ের প্রশংসায় আমার আর মাথা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন মা দিব্যি সবার
সামনে আমার প্রশংসা করত। বলত “রুম্পাই কে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই শুধু ওর
পড়াশুনাটা ছাড়া”। মা কোনদিন যেমন আমার কোন সুকর্মের দায় নিতে আসেনি, তেমনি, আমাদের কুকর্মের
সব দায়ে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। দোষ করলেই বলেছে “নিশ্চয়ই আমার শিক্ষায়
কোন ত্রুটি ছিল। আর ভালো কাজ করলে কখনও বলতে শুনিনি “কেমন শিখিয়েছি
আমার মেয়েকে দেখেছ?”
এখন যখন আমি
মাকে বলি যে তোমার শিক্ষায় বড় হয়ে আমার কোন আপসোস নেই বরং অনেক গর্ব আছে, তখন মা
বলে মায়ের কিন্তু নাকি একটু আপসোস আছে। মা নিজে যেমন কাঠখোট্টা, আমিও নাকি তেমনি
হয়েছি। আমার মধ্যে তেমন ন্যাকামি নেই, লোক দেখানো ভালোবাসা বা আদিখ্যেতা নেই। আর
এখন দুনিয়ায় নাকি এসবেরই বেশী দাম। আমার
কিন্তু দিব্যি লাগে এই বিনা ন্যাকামির কাঠখোট্টা জীবন। কারণ আমি বিশ্বাস করি লোক
দেখানো ন্যাকামি দিয়ে তাৎক্ষণিক পাত্তা পাওয়া গেলেও শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা
কোনটাই পাওয়া যায় না।
হঠাত করে
মায়ের কথা, মায়ের শিক্ষা নিয়ে কেন লিখতে বসলাম? কাল মা ফিরে গেল নিজের সংসারে । মা
একমাসের জন্য আমার ব্যাঙ্গালোরের সংসারে এসেছিল। আমার মেয়েকে দেখাশুনা করে যে
দিদি, সে একমাসের ছুটিতে গেছে, তাই। আমরা অফিস গেলে মেয়েকে দেখবে বলে। সেই মা রোজ
ভোর ৬টায় উঠে কাজ করতে শুরু করে দিত। একেবারে চা বানিয়ে আমাদের ঘুম থেকে ডাকত। মা
আসার আগে আমাদের মেয়ের জীবনে কোন সঠিক রুটিন ছিল না। মা এসে কি সুন্দর জীবনে একটা
নিয়ম এনে দিয়েছে! সময়ে স্নান, খাওয়া, ঘুম। আমরা অফিসে চলে গেলে মা ওর সাথে বই নিয়ে
বসত। টুনটুনির গল্প, ইকিরমিকির, আগডুম বাগডুম আরও কত কি! এই কদিনে মা দেখিয়ে এবং
শিখিয়ে দিয়ে গেল কি সহজে শিশুদের ভালোবাসা পাওয়া যায়, কি সহজে বাচ্চা মানুষ করা
যায়। কোন আড়ম্বর লাগেনা, লোকদেখানো ন্যাকামি লাগেনা। নিছক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর
ভালো চাওয়া দিয়েই এই সহজ কাজটা হয়ে যায় অনায়াসেই।
এইকদিন মা
আমাকে কোন কাজ করতে দেয়েনি। কিছু বললেই বলত “আমি চলে গেলে তো সব কাজই তোকে করতে
হবে। আমি তো তোকে আরাম দিতেই এসেছি”। কিন্তু আজ মা আবার নিজের সংসারে ফিরে যাওয়ায়
সব কাজ নিজেকে করতে কোন কষ্টই আমার হচ্ছে না। কিন্তু মায়ের এত ভালোবাসার কথা মনে
করে আর মাকে মনে করে বাচ্চাদের মত কষ্ট হচ্ছে। মা কাল ফিরে গিয়ে এত সুন্দর একটা
কথা বলল... একটা কথাতেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিল মা! মা বলল, “লোকে বলে আসলের চেয়ে
সুদের প্রতি দরদ বেশী। কিন্তু, আমার নাতনির জন্য অত কষ্ট হচ্ছে না। কারণ আমি জানি
ওর মা বাবা ওর সাথে আছে। আমার তোর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, চিন্তা হচ্ছে, কারণ ওখানে
তুই একা”।
সত্যিই মা যে
আমার কত বড় ভরসা, আশ্রয়, শিক্ষা, সে আমিই জানি। শুধু আমার মা বলেই না। কিন্তু এই মায়ের কাছেই আমি শিখেছি কি করে কোনরকম
কপটতার আশ্রয় না নিয়ে শুধু মাত্র নিজের সুকর্ম দিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান আর
ভালোবাসা পেতে হয়। আর আমার বাকি জীবনের এখন একটিই উদ্দেশ্য। আমার মায়ের মত একজন মা
হয়ে ওঠা। আমি যেন আমার এই কন্যার এতটাই ভরসার জায়গা, আশ্রয় হয়ে উঠতে পারি। যে
সুশিক্ষায় আমি বড় হয়েছি, মেয়েকেও যেন সেই শিক্ষায় বড় করতে পারি। মাতৃঋণ তো কোনদিন
শোধ হয়না। তবু মায়ের যোগ্য সন্তান আমি সেদিনই হয়ে উঠব।
Subscribe to:
Posts (Atom)